ডায়াবেটিস শব্দটি আমাদের কাছে খুব পরিচিত এবং প্রায়শ আমাদের চারিপাশের মানুষের মাঝে এই রোগের কথা শোনা যায়। ডায়াবেটিস এর ভয়াবহতা এমনভাবে বেড়েছে যে এখন প্রায় প্রতিটি পরিবারের মধ্য এই রোগ আক্রান্ত ব্যক্তি খুজে পাওয়া যাবে। আগে যেখানে শুধুমাত্র শহরের ডায়াবেটিস রোগী দেখা দিত কিন্তু এখন সেটা শহর ছাপিয়ে গ্রামে পৌঁছে গেছে। ডায়াবেটিস রোগের ব্যপকতা পর্যালোচনা করে বর্তমানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডায়াবেটিস কে মহামারি রোগ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
ডায়াবেটিস কি?
ডায়াবেটিস হল এমন একটি দীর্ঘস্থায়ী অবস্থা যা শরীরের গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় এবং শরীরের রক্তে শর্করার মাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রন করতে পারে না। শর্করা বা গ্লুকোজ আমাদের শরীরের প্রধান জ্বালানি। ইনসুলিন তৈরি হয় অগ্ন্যাশয়ের বিশেষ কোষ আইলেটস যা মানব শরীরের কোষগুলোতে শর্করা প্রবেশ নিয়ন্ত্রন করে। যখন আমাদের শরীর নিজ থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না এবং তৈরি হওয়া ইনসুলিনের কার্যকারিতা সঠিকভাবে কাজ করে না তখন আমাদের রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজের পরিমান অস্বাভাবিক হারে পাওয়া যায়। এই অবস্থাকে সাধারনত ডায়াবেটিস বলা হয়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে আমরা যখন কার্বোহাইড্রেট বা শর্করাজাতীয় খাবার খাই, সেই খাবার বিশেষ প্রক্রিয়াইয় গ্লুকোজ তৈরি হয়। আমাদের শরীরে তৈরি হওয়া গ্লুকোজ ইনসুলিন নামক হরমোন মানব শরীরের কোষগুলোতে পৌঁছে দেয়। আমাদের শরীরে কাজ বা অন্য যেকোন কাজ করতে যে শক্তির প্রয়োজন হয় তা তৈরি করে গ্লুকোজ। ডায়াবেটিস এর ফলে আমাদের শরীরের ইনসুলিন তৈরি হওয়ার কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে শরীরের কোষে সঠিকভাবে গ্লুকোজ পৌঁছায় না। গ্লুকোজের অভাবে শক্তি উৎপাদন কম হয় ফলে স্বাভাবিক কাজ কর্ম ব্যহত হয়।
ডায়াবেটিস এর ফলে মানুষের শরীরে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যার অস্বাভাবিক ভাবে। যখন রক্তে গ্লুকোজ বেড়ে যায় এবং সেটা কোষে পৌঁছাতে পারে না। তখন প্রসাবের মাধ্যমে আমাদের শরীর থেকে গ্লুকোজ বের হয়ে যায়। এই কারনে ডায়াবেটিস রোগীর ঘন ঘন প্রসাব হয়। তাই ডায়াবেটিস রোগকে অনেক সময় বহুমূত্র রোগ বলা হয়। ডায়াবেটিস রোগীর যখন অস্বাভাবিক ঘন ঘন প্রসাব হয় তখন রোগী খুব পানি পিপাসা লাগে।
ডায়াবেটিসের প্রকারভেদ
টাইপ -১ ডায়াবেটিস ও টাইপ -২ ডায়াবেটিস
টাইপ -১ ডায়াবেটিসঃ টাইপ -১ ডায়াবেটিস দেহের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা (ইমিউন সিস্টেমস) কে ব্যহত করে ফলে ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকে ধ্বংস করে দেয়। যেহেতু ইনসুলিন উৎপাদন কমে যায় তাই গ্লুকোজ কোষে পৌঁছাতে পারে না। এই ধরনের ডায়াবেটিস সাধারণত শিশু ও কিশোরদের মধ্য বেশি হয়। তবে এক গবেষণায় দেখা গেছে ১০ থেকে ৩০ বছর বয়সের মধ্য টাইপ -১ ডায়াবেটিস বেশি দেখা দেয়। এই ধরনের রোগীকে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্প ব্যবহার করা হয়। যদি ইনসুলিন ব্যবহার না করা হয় বা সঠিকভাবে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রন করা না হয় তাহলে খুব দ্রুত রক্তে শর্করা বা গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যায়। ফলে রক্তে অস্বাভাবিক গ্লুকোজের কারনে রোগী অজ্ঞান হয়ে যায় এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। টাইপ ১ ডায়াবেটিস সাধারণত জেনেটিক বা বংশীয়ভাবে হয় থাকে।
টাইপ -২ ডায়াবেটিসঃ আমাদের দেহে যে ইনসুলিন তৈরি হয় তা সঠিক ভাবে যখন কাজ না করে সেটা ডায়াবেটিসের লক্ষণ এবং সেই ডায়াবেটিস কে টাইপ -২ ডায়াবেটিস বলে। টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীর দেহে ইনসুলিন তৈরি হয় কিন্তু সেটা পর্যাপ্ত পরিমানে ইনসুলিন তৈরি হয় না। ফলে গ্লুকোজ সঠিক পরিমানে কোষে পৌঁছায় না। টাইপ-২ ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগের পেছনে থাকে মুলত ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীর মধ্য প্রায় ৯০ শতাংশ হলো টাইপ-২ ডায়াবেটিস। এই শ্রেণীর রোগীর বয়স সাধারণত ত্রিশ বছরের উপরে হয়ে থাকে। তবে টাইপ -২ ডায়াবেটিস রোগীদের সাধারণত ইনসুলিন ব্যবহাণত করার প্রয়োজন হয় না।
টাইপ-২ ডায়াবেটিস রোগীরা সাধারণত স্থুলকায় হয়ে থাকে। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন বা নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রন করা যায়। তবে কোন কোন সময় সামান্য পরিমান মুখে খাওয়া ঔষুধ বা ইনসুলিনের ব্যবহার করার প্রয়োজন হয়ে থাকে। মিষ্টি জাতীয় খাবার বা মিষ্টিজাতীয় পানীয় এই রোগ বাড়ায়। সুতরাং ডায়াবেটিস রোগীর মিষ্টিজাতীয় খাবার খাওয়া উচিৎ নয়। অতিরিক্ত পরিমান সাদা ভাত খাওয়ার কারনে ডায়াবেটিস রোগের ঝুকি বাড়ায়। শারীরিক পরিশ্রম না করাও টাইপ-২ ডায়াবেটিস অন্যতম প্রধান কারন।
গর্ভকালীন বা মাতৃত্বকালীন ডায়াবেটিসঃ অনেক সময় গর্ভকালীন সময় গর্ভবতী নারী বা প্রসূতিদের রক্তে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যায়। কিন্তু প্রসবের পর ইনসুলিনের কার্যকারীতা পুর্বের ন্যায় ঠিক হয়ে যায় । সুতরাং প্রসবের পর গর্ভবতীর ডায়াবেটিস আর থাকে না। গর্ভকালীন এই জটিলতাকে বা ডায়াবেটিস কে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস বলে। গর্ভকালীন সময়ে নারীদের ডায়াবেটিস হলে সেটা খুবই বিপদজনক হতে পারে। গর্ভবতী নারীর ডায়াবেটিস হলে প্রসূতি শিশুর ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। গর্ভকালীন অবস্থায় প্রসূতির রক্তে অস্বাভাবিক ভাবে গ্লুকোজের পরিমান বেড়ে যায় তাই ঝুঁকি এড়ানোর জন্য ইনসুলিনের ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য। গর্ভবতী মায়ের শরীরে স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় বেশি ইনসুলিনের প্রয়োজন হয় রক্তে গ্লুকোজের পরিমান নিয়ন্ত্রনের জন্য।